প্রকাশিত: Thu, Apr 18, 2024 11:26 AM
আপডেট: Sun, Dec 7, 2025 12:54 AM

মঙ্গল হোক সবার

ড. সেলিম জাহান : জগতের সব শাস্ত্রই মানুষের মঙ্গলের কথা বলে। কারণ সে মঙ্গল কামনা মানবতার মূল কথা। মানব-মঙ্গল কামনা প্রক্রিয়ায় আচার-বিধান বড় কথা নয়, তার অন্তর্নিহিত বোধটিই হচ্ছে মুখ্য। মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণের তিনটে মাত্রিকতা আছে। প্রথমত: নতুন বছরের শুরুতেই মানবিকতার চেতনা, মানুষে-মানুষে সৌহার্দ্য, আন্তঃধর্ম সম্প্রীতির প্রতি আমাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা। সেই সঙ্গে অভিব্যক্ত করা আমাদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের আনন্দ, সৌহার্দ্য আর সম্প্রীতির সুখ, ধর্মীয় শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নিরাপত্তা। এখানে মানবতাই বড়। দ্বিতীয়ত: মঙ্গল শোভাযাত্রা বাঙালি সংস্কৃতির একটি দিক, বাঙালি ঐতিহ্যের অংশ। তৃতীয়ত:  সব মানুষই মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করতে পারে। আমাদের বিভিন্ন আত্মস্বত্ত্বার বা আত্মপরিচয়ের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। 

প্রকৃত প্রস্তাবে, আমাদের প্রত্যেকেরই বহুমাত্রিক আত্মঃস্বত্ত্বা রয়েছে। আমাদের মাঝের যেকোনো একজন মানুষকেই ধরা যাক না কেন। একইসঙ্গে তিনি হতে পারেন বাঙালি, মুসলমান, নারী, পেশাজীবী, মধ্যবয়স্ক, সম্তানের জননী ইত্যাদি। এ সবই তাঁর বহুবিধ আত্মপরিচয়ের নানান দিক। এই সব স্বত্ত্বার মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই এবং বাস্তবে তাঁর এই বিভিন্ন স্বত্ত্বার মধ্যে ক্ষেত্রবিশেষে তাঁর এক বা একাধিক স্বত্ত্বা প্রাধান্য পায়। যেমন, একজন মানুষ যখন কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন, তখন তাঁর ধর্মীয় স্বত্ত্বাটিই প্রকাশ পাচ্ছে। তিনি যখন একটি বৃদ্ধদের সংগঠনে যোগ দিচ্ছেন, তখন তাঁর বয়ঃক্রমিক স্বত্ত্বাটিই মুখ্য হয়ে উঠছে। কর্মক্ষেত্রে কিন্তু এই মানুষটিই আবার পরিচিত তাঁর কাজের প্রকৃতি দ্বারা। অন্যদিকে তিনি যখন সন্তানদের আদর করেন, তখন তাঁর মাতৃস্বত্ত্বা বা পিতৃস্বত্তাই পরিস্ফুট হয়।

কোনো মানুষেরই কোনো একটি বিশেষ আত্মস্বত্ত্বা দিয়ে পরিচিত হতে কোনো দোষ নেই। তিনি সে স্বত্ত্বাটি বাছাই করে নিতেই পারেন। কিন্তু সমস্যা হয় তখনি, যখন একটি মানুষ প্রেক্ষিত নির্বিশেষে সর্বাবস্থায় একটি মাত্র আত্মপরিচয়ের ছাঁচে নিজেকে ঢেলে দেন এবং সেই আত্মস্বত্ত্বাকেই সবচেয়ে কুলীন এবং সর্বশ্রেষ্ঠ বলে একটি চরম অবস্থান নেন। সেই সঙ্গে অন্যদের আত্মস্বত্ত্বাকে নিকৃষ্ট বলে মনে করেন। সে অবস্থায় একটি দ্বন্দ্ব, একটি পীড়ন, একটি বিদ্বেষ, একটি বিভাজন, একটি সংঘাত এসে  উপস্থিত হয়। যেকোনো অপশক্তিই তো সমাজে মানুষে মানুষে ওই বিভাজনটিই চায়, ওই বিদ্বেষটিই লালন করে এবং ওই সংঘর্ষের জন্যই লালায়িত হয়।

কোনো অপশক্তিকেই তো এমন একটি অপপ্রয়াসের কোনো মোক্ষম সুযোগ তো আমরা দিতে পারি না। আমাদের প্রত্যেকের বহুমাত্রিক আত্মপরিচয় আমরা বজায় রাখবো, ভিন্নতর প্রেক্ষিতে বিভিন্ন আত্মপরিচয়ে পরিচিত হব এবং সবার নানান আত্মপরিচয়ের প্রতি সহনশীল ও শ্রদ্ধাবান থাকবো। সুতরাং বাঙালি আত্মপরিচয়ের প্রেক্ষিতে মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমরা সবার মঙ্গল কামনা করি। কারণ ওটা আমাদের বাঙালিত্বের ঐতিহ্য, আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির অংশ, বাংলা নববর্ষ উৎসবের প্রাণ। চিরায়ত বাংলাদেশে সনাতন কাল থেকে সব বাঙালিই ওটি করেছে, আজও করছে, ভবিষ্যতেও করবে। লেখক: অর্থনীতিবিদ